অনুশাসন ও ইউনিফর্ম
আমাদের ছোটবেলায় "অধিকার" শব্দটার মানে অনেকেই বুঝতো না। আমরা জানতাম খেলা,মজা, পড়া, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদী। কেননা আমরা আর আমাদের প্রজন্ম এই বাগদা বাগদা শব্দের দিকে উদ্ভাসিত ছিলাম না। আমাদের সময় আমরা শিক্ষক কে শ্রদ্ধা করতাম আর কিছু অংশে ভয় ও পেতাম। আমরা এই তথ্যটা ভালো ভাবে জানতাম কি যদি আমাদের বিরুদ্ধে শিক্ষক কোনো অভিযোগ করে তালে শিক্ষক আর আমাদের মাতাপিতা এক দলে থাকবেন।
পর্ণশ্রীর কাছা-কাছী আমার পাঠশালা ছিল। যেটা বলতে পারেন একটা Pre-Primary School যার নাম ছিল Sunny Preparatory School । আমি ওখানে তিন বছর কাটাই আর ওখানে তৈরী হয় আমার শৈশবের অনুশীলন। অনুশাসন আমাদের জীবনে খুব দরকার। আপসোস এটা আমরা বাল্যজীবনে বুঝতে পারি কিন্তু প্রাপ্ত বয়েসে আমাদের কেমন যেন একটা মানসিক দূষণ হয়ে যার ভিত্তি তে আমরা এই সব অনুশাসনিক পদ্ধতির জলাঞ্জলি দিয়ে দি বা একটা ঘুলঘুলি বের করে নি। বড়ো হওয়াটা যে এই দেশে কত বড়ো অপরাধ তা আর কি বলবো। তা থাকে এখন অনুশাসনে ফোকাস করা যাক।
স্কুলে রেভা আন্টি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। অবশ্য আমার দুস্টুমি অগ্রাহ্য করতেন না। তবে তিনি এমন এক জন টিচার যার কাছ থেকে আমি ওই স্কুলে স্ক্যালের বাড়ি খাই নি। তাই আমার ভারী পছন্দ। একদিন আমাকে কেউ বলেছিলো যে স্কুলে এই ইউনিফর্ম জাতীয় জিনিষটা একটা সাহেবি কায়দার নকল। আমি অবশ্য তখন সাহেব, ফরাসি, জাপানি কিছুই বুঝতাম না কিন্তু বাবাদের আড্ডায় আড়ি পেতে এইটা শুনতে পেরেছি। আর রীতিমতো এইটা বুঝতে পেরেছি কি বাবা আর তার বন্ধুরা খুব একটা উনিফর্মের সমর্থক না। ব্যাস আমার ভেতরের বাঘা যতীন খেয়ে দিয়ে অনশনের জন্য প্রস্তুত। আমিও ভেবে নিলাম কি এই ইউনিফর্ম কে ত্যাজ্য করে নিত্য নতুন জামা পরে স্কুলে যাবো। বিদ্রোহ হলো আমার মার সামনে আর পাখার (হাত-পাখার) বাড়িতে সে বিদ্রোহ ক্রন্দনের সুর করে দমন হলো। তবে বিদ্রোহ-দমন রেখে গেলো একটা প্রশ্ন আর সেইটা হলো ইউনিফর্ম কত জরুরী ?
সোমবার স্কুলে গেলাম আর নির্ধারিত করলাম কি রেবা আন্টির সাথে কথা বলবো। কেননা আমার এই ক্রান্তিকারী বিচার শুনে স্কেল না মারার নির্ণয় খালি উনি নেবেন আর আমি পাখার বাড়ি আগেই খেয়ে নিয়েছি।
রেবা আন্টি কে জিজ্ঞেস করলাম "আন্টি বোলো তো সবাই বলে কে ইউনিফর্ম হলো সাহেবি কায়দা তালে আর সাহেবি কায়দা খারাপ তাহলে আমরা ইউনিফর্ম কেন পরী?"
রেবা আন্টি হাসেন আর আমাকে বলেন " বাবা এতো বড় বড় কথা তুমি কি করে জানলে ?"
- " আমি আড়ি পেতে বাবা আর ওদের বন্ধুদের আড্ডা শুনেছিলাম "
- "তাই নাকি আর কি শুনেছ ? "
- " এই যে ইউনিফর্ম সাহেবি কায়দা, আগে নাকি ইউনিফর্ম ছিল না , আর কি সব পন্থী তন্থী ----"
- " বামপন্থী ?"
- " হ্যা হ্যা ওই বামপন্থী"
- " ও আচ্ছা। তার পর। "
- "অন্য দেশে নাকি এসব হয়ে না আমাদের দেশে এসব লাগানো এমন তেমন। "
-" শোনো কল্যাণ ইউনিফর্ম হলো একটা অনুশাসনের জিনিস "
- "অনুশাসন ? মানে "
- "আচ্ছা তালে এই ভাবে বলি। আমাদের স্কুলে অনেক বাচ্চা পড়ে। কারুর পরিবার ওদের পুজোর সময় খুব ভালো জামা কিনে দে আর কারুর পরিবার ওদের ওতো ভালো জামা কিনে দিতে পারে না। এবার যদি ইউনিফর্ম না থাকে তালে কেউ খুব ভালো জামা পরে আসবে আর কেউ অটো ভালো জামা পরে আসবে না। তার মানে সবাই সমান হবে না। আর যারা ওই ভালো জামা পড়া বাচ্চাদের দেখবে তারা এই আবদার ওদের মা বাবা কে করবে। আর মা বাবার সেই আবদার পুরো করতে পারবে না। তাতে কি ভালো হবে ?"
- "না আন্টি তাতে তো খুব ভালো হবে না। ওরা কষ্ট পাবে। "
- "তাই তো। সেই জন্য এই ইউনিফর্ম করা। যাতে সবাই এক সমান দেখায়। UNI মানে হলো একরকম আর FORM মানে হলো দেখানো, সেই ক্ষেত্রে UNIFORM মানে সবাই কে এক মতন দেখানো। আর সবাই যদি এক রকম দেখায় তালে সবাই কে এক রকম ভাবে দেখা হবে আর সবাই কে এক রকম ভালোবাসা বা মার দেওয়া হবে। "
আমি বুঝতে পারলাম দুটো জিনিস।
১. সমানভাবে ভালোবাসা আর মারের জন্য এই ইউনিফর্ম ই দায়ী।
২. সাহেবরা সব কিছু খারাপ করে যায় নি।
সেদিন থেকে আমার ইউনিফর্ম এর প্রতি টান আরও বেড়ে গেলো আর আমি খুব সংবেদনশীল হয়ে গেলাম এই ইউনিফর্ম নিয়ে।
আজকে বুঝতে পারি রেবা আন্টি কত বড়ো কথা বলেছিলো। আমরা আজকেও অনেক লোকেরা এই কথা বুঝতে পারে না। আজকে এমন অনেক স্কুল আছে যারা ফ্যাশন ডিসাইনার দিয়ে ইউনিফর্ম বানায় আর গ্রাফিকাল ডিসাইনার দিয়ে বই ডিসাইন করে। স্কুল , পাঠশালা, বিশ্ববিদ্যালয় আজ একটা বাণিজ্যিক রঙ্গভূমি আর এই রঙ্গভূমিতে স্নাতক আর অভিভাবকরা জোকার হয়ে ঘুরে বেড়াই। আজকে রেবা আন্টির মতো শিক্ষকের অভাব তাই আমরা একটা ভীতু আর একটা non-informed প্রজন্মকে প্রশ্রয় দিচ্ছি।
ইতি
কল্যাণ
No comments:
Post a Comment