সন্ধ্যা বেলা যখন শংখ বাজে তখন কেমন একটা অন্য রকম বাতাবরণ হয়ে ওঠে । মা বলে, কি ভগবান নাকি সন্ধ্যে বেলায় এক বার নজর দিয়ে দেখেন কি মর্ত লোকে বসবাস যারা করে তারা কি ঠিক মতন আছে না কারুর কোনো রকম কষ্ট হচ্ছে । তাই নাকি সন্ধ্যে বেলায় ঘুমোতে নেই । দেবতারা ভুল প্রতিক্রিয়া পান। শংখ বাজিয়ে ঘরের লোকেরা জানায় কি সব মঙ্গল আছে আর প্রার্থনা করে যেন সব মঙ্গল থাকে । আমার জন্য অবশ্য শংখ ছিল একটা বিপদ্সঙ্কেত, যেটা আমাকে বলত কি " এবার খেলা ছেড়ে বাড়ি যাওয়া উচিত নত পেদানী হতে পারে ।
আজ সহরের এই কোলাহলে খুব কম শংখ সোনা যায়ে। মার কথা যদি সত্তী হয়ে তালে এর দুটো তাত্পর্য হতে পারে ।
১. হয় তো সবাই এত সুরক্ষিত কি আজ কাল ভগবানকে কুশল সমাচার দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না ।
২. নত হয়েত ঈশ্বরের ভয় আর মনে নেই, তাই এই দৃষ্টতা ।
নত কি আওয়াজ এত কি শাঁখ সুনতে পাওয়া জায়েনা ।
যাক গে, অত যদি ভাবতে যাই তালে স্মৃতির পাতা উল্টোনো মুশকিল হয়ে যাবে ।
চুপি সারে ঘরে পৌছে যাই । আমরা যেই ভাড়া বাড়িতে থাকতাম তার সামনে মুখের্জী জেঠুর বিরাট জমিদার বাড়ি । বনেদী বাড়ির ঔজ্বল্য ও ঐশ্বর্য তখন পড়ে জায়েনী । তখন বেশ বড় বাড়ি , ঠাকুর দালান, চাকরের সেনা ও একটা মস্ত বড় রান্নাঘর, যেটা আমাদের গোটা ভাড়া বাড়ির থেকে দ্বিগুন বড় হবে । তবে মুখের্জী জেঠু কে দেখে কিন্তু মনে হত না কি উনি অত বড় জমিদার ও একটা lathe কারখানার মালিক । সন্ধ্যে বেলায় নিয়মিত মুখের্জী জেঠু বিশাল চত্বরে পায়চারী করে করে সসা খেতেন । জমিদারী মেজাজ প্রায় না বললেই হয়ে । অবশ্য এই জমিদারী মেজাজ না থাকার একটা বিশেষ কারণ আছে বটে । মাথায় প্রচন্ড চিন্তা ।
ভাস্কর , মুখের্জী জেঠুর গুণধর সন্তান, ও একমাত্র সম্পত্তি যার ওপরে ভারত সরকারের দাবি তখন অবদি হয়ে নী । অবশ্য সেইটা নিয়ে মুখের্জী জেঠু কোনরকম গর্ব দেখাতেন বলে তো মনে হত না । তবে ভাস্করদা আমার ছোট বয়েসের আদর্শ বলে ভুল হবেনে । মা, বাবা সবাই তখন নিজের ছেলেদের রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্র বসের উদাহরণ দিতেন, আমি চাক্ষুষ রবীন্দ্রনাথ দেখতাম সামনে । ভাস্করদা আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিশেষ কিছু পার্থক্য ছিল না । দুজনেই জমিদার বাড়ির গুণধর, দুজনেদের পেছনে ১৪ খানা মাস্টার , দুজনেদের পড়ায় কোনো মন ছিল না আর দুজনেরই রুচি ছিল কলায়ে । অবশ্য ভাস্করদার জন্য সেই কলাটা যদি সিঙ্গাপুরি হত তালে রুচি আরও বেশি নিত ।
" বাবু। ...... ও বাবু।.. সন্ধ্যে হয়ে গেছে, এবার হোম ওয়ার্ক শেষ করে নাও। নাত আবার পিটানি হবে। "
জানিনা কেন যে কাজের আগে মারের হুমকি হত। আজকাল কার দিনের মাফিয়ারা কিন্তু আমাদের আগেকার দিনের মা বাবার মত হতে পারবে না । খালি দুটো প্রতিক্রিয়া । নয়তো আইসক্রীম খাওয়াবে নয়তো উধম কেলাবে । আমাদের পাড়ার একজন ভদ্রলোক বাড়িতে এসে রোজ এই হুমকি কে ইন্ধন যোগাতেন।
" বৌদি তারকদার ছেলে, কি দুরন্ত ছিল, কি বলব। তাকে আজে দেখে মনে হয়েনা ওই বাঁদরকে দেখছি। "
" কেন কি হয়েছে নতেদা ?"
" সেই ছেলে এখন ডাক্তার। "
" বলেন কি! কি ভাবে ? "
" তারকদার গুন আছে বলে ভুল হবে না। ওই বাঁদর ছেলেটাকে প্রায় ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে ডাক্তার বানিয়ে দিলে ।"
" তাই নাকি। রুমা বৌদির কি সৌভাগ্য। সত্তী এক অবিশাস্য ঘটনা ।"
নতেদা, আমাদের পাড়ার চলন্ত সংবাদপত্র। কার বাড়িতে কত কাক এসেছে কত গমের দানা সরাতে পেরেছে তার খবর রাখতেন, অবস্য এই কাজ আজকাল আমাদের news channel গুলো করে, তবে তখন তো আর satellite TV ছিলনা, তাই নতেদা এই শূন্যতা পূর্ণ করত ।
আমি খালি সুনি "ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে ডাক্তার করে দেওয়া। " হঠাত কেন যেন ডাক্তারি পেশা একটা খুব নিকৃষ্ট পেশা বলে মনে হলো। মনে মনে ভাবলাম মার খেতে খেতে যদি ডাক্তার হয়ে তাই বোধ হয় নির্দয় হয়ে ছুঁচ ফোটাতে পারে।
মোড়ের মাথায় ঘোষ ডাক্তার বসতেন, মনে হলো তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কত কেলানি খেয়েছেন।
নতেদা নিজের চা শেষ করে চলে গেলেন, আবার কাল আসবেন বলে, আজ আমি ঢুকলাম পড়তে, বলেছিলাম না, কাল বুধবার, নখ পরীক্ষণ আছে ।
No comments:
Post a Comment