বুধবার সকাল বেলা। তখন বাজে ছটা। সুধার মা , আমাদের কাজের লোক আর এক ঘন্টার মধ্যে এসে উপস্থিত হবেন। রাত্রীর বাসন এখনো পড়ে আছে আর সুধার মা না আসলে কাজ বেড়ে যাবে। কাজের লোকের আগমন যেন একটা আবির্ভাবের মহত্য একটা গৃহনির জন্য। জেঠু বলে কি সব পুজোর মধ্যে বিষ্ণু পুজো করে বিষ্ণু কে সন্তুষ্ট করা নাকি সবচে কঠিন, তেমনি একটা ভালো কাজের লোক পাওয়ার জন্য বিষ্ণু পুজো করা অনিবার্য, আমার মা বোধ হয় বিষ্ণু পুজো তে উত্তীর্ণ হয়েছিল তাই সুধার মার মত সময়নিষ্ঠ ও নিয়মনিষ্ঠ কাজের লোক পেয়েছিল।
তবে সেই দিন বোধ হয় বিষ্ণু তাকুরের আলাদা মত ছিল। সুধার মা সেদিন আসলো না। তাড়া হুড়ো তে নখ কাটা হলো না । সন্নি স্কুল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় অর্ধেক কিলোমিটার দুরে ছিল । সাধারণত হেটে যেতাম, বাবা অফিস যাওয়ার পথে ছেড়ে দিত আর মা দুপুরবেলা নিয়ে আসত ।
নখ তো কাটা হলনা আর নখ না কেটে স্কুলে প্রবেশ করলাম। প্রার্থনা গাওয়া হলো, তারপর নখ পরীক্ষনের পালা ।
সব ছাত্রালয়ে বিদ্যাসাগরের গোপাল ও রাখল দুজনেই বসবাস করে। আমার খ্যাতি অবশ্য রাখালের মত ছিল । দুষ্টু বা দুরন্ত বললে ন্যূনোক্তি হবে বরঞ্চ আমাকে উগ্রপন্থীর শ্রেণীতে রাখা গেলে ভুল হবে না ।
"কল্যাণ আজকে নখ কেটে আসনি ?"
" না । মা আজকে নখ কাটতে পারেনি ।"
"কেন?"
"সুধার মা ডুব মেরেছে ।"
"সুধার মা? কে সুধার মা ?"
"আরে আমাদের কাজের লোক আন্টি , ও আজ ডুব মেরেছে ।"
"ডুব মেরেছে মানে, এটা কি কোনো ভাষা হলো? এমন ভাবে বলতে হয়ে? "
"আমি যা সুনেছি তাই বলেছি আন্টি "
You should always cut your nails. This is not the way to come to the school, I will have to call your father. Give me your hand.
এমন সব সুনে আমি আমার হাথটা আগে করে দী আর সটাং করে একটা স্কেলের বাড়ি খাই । কিছুক্ষণ ব্যথা করে বটে কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে ।
তবে এই কুকর্মে যে আমি একা নয় সেইটাও জানি । পলী মাসির মেয়ে শায়লা সেও আমার সাথে ওই সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল । শায়লা অবশ্য ওই স্কেলের বাড়ি ভালো ভাবে নিতে পারল না । দু চোখ দিয়ে গঙ্গা আর যমুনা বয়ে চলেছে । কি জানে কোন কারণে নিয়মিত ভাবে নখ কাটার প্রার্থী আজ নখ না কেটে এই আসামী পল্টনে দাঁড়িয়ে ছিল ।
"তুই নখ না কেটে এসেছিস "
" হ্যা "
" কেন পলি মাসি কেটে দেয়েনি "
শায়লার এই কথা সুনে কান্না আরও বেড়ে গেল । আসলে ব্যাপার ঠিক অন্য । ও কিন্তু পছন্দ করত না কি কেউ বলুক পলি মাসি অর নখ কেটেছে কেননা, শায়লা আমাদের মধ্যে একটা ছাপ বানিয়ে রেখেছিল কি অর নখ ও নিজে কাটে। আমি অবশ্য সত্যের সন্ধান পাই যখন অর বাড়িতে খেলতে যাই। শায়লা অর নখ কাটে না । পলি মাসি অত্যন্ত যত্নে ওর নখ কেটে দেয়ে। শায়লার এই গোপনীয় সত্য তখন খালি আমি জানি । তাই নিয়ে সেই কান্না ।
খুব ঝগড়া হত আমাদের, আবার আমরা সবাই মিলে খেলতাম খুব ভালো করে আমি, শায়লা, সৌরজ্যতি , ইন্দ্রনীল , স্বস্তিকা ও রণদীপ । ইংরেজি ক্লাস শেষ হবার পরেই খেলার সময় অবধি ছিল । তাই শায়লা কে বললাম
"এই শায়লা "
"কি ?"
"আমি কিন্ত সব জানি"
"তার মানে"
"আমি কিন্তু সবাইকে বলে দেব কি তুই তর নখ নিজে কাটিস না, পলি মাসি কেটে দেয়"
"না। এমন করিস না। তুই নাকি আমার বন্ধু।"
" হ্যা সেটা ঠিক কিন্তু যদি তুই চাস কি আমি কাউকে না বলি তালে লুকোচুরি খেলায় আজ আমি দান দেব না । আমার দান তুই দিবি ।"
এই ছিল আমার প্রথম business deal । আজ যখন নিজেকে দেখি, নিজের পেশা কে দেখি , তখন বুঝতে পারি কি এমন কত কত business deal যে করেছি । কিন্তু ওই চুক্তি তে যে আরাম পেয়েছিলাম সেই আরাম আর সন্তুষ্টি বোধ হয়ে আর পায়েনি । ব্যবসায়ে যদি ছলাকলাশূন্যতা থাকত তালে কত ভালই না হত । যদি এই বিশ্বে সব নির্ণয় একটা বাচ্চার কচি মন নিতে পারত তালে কি এত গ্লানি, এত দুখ, এত ভ্রান্তি থাকত? বোধ হয়ে না ।
হঠাত চোখের সামনে দিয়ে যেন একটা আগুনের ঝলকানি হয়ে গেল । শায়লা কে ডাকার চেষ্টা করলাম । খানিকটা জোরে, কিন্তু আবাজ পৌঁছলো না । সেদিন ও যে দান দিয়েছিল সেটা বোধ হয়ে আজ দিচ্ছে , নত আমি হয়েত লুকিয়ে আছি এমন কোনো স্থানে যেখানে দান দেওয়ার পাত্রী শায়লা তো এক দিকে, নিজেই নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি না ।
আমরা নিজেকে প্রগতিশীল বানিয়েছি, আলু কাবলি ছেড়ে হয়েত আলু-প্যাটি বার্গার খাচ্ছি, কিন্তু সন্তুষ্টি, শান্তি, আর খুশি কি পাচ্ছি? হয়েত সেটার উত্তর আমি নিজেও দিতে পারব না বা দিতে চাইনা । কেননা ইদুর দৌড়ে দৌড়তে দৌড়তে আমি ল্যাজ বাঁচাতে ব্যস্ত । আমিও হয়ত মানুষরুপী ইদুর ।
বৈজ্ঞানিকরা বলে, স্বপ্ন শ্বেত-শ্যাম বর্ণ হয়ে , তবে স্মৃতি কিন্তু রঙ্গীন হয়ে। জানিনা শ্বেত-শ্যাম যুগের স্মৃতিগুলো আবার রঙ্গীন ভাবে দেখাতে পারব কি না ।
এর বর সোনাব সৌরজ্যতির কথা.... আমাদের "reference point"... যাকে বলে হীরের টুকরো ছেলের কথা...
No comments:
Post a Comment