দিন টা ৯ ই আগস্ট ২০২৪, শুক্রবার। আমি সপ্তাহের শেষের সব গতিবিধি আমার অফিসের সাপ্তাহিক বিবরণে অংকিত করছিলাম। শুক্রবার সন্ধ্যাবেলায় এইটা আমার একটা নিত্যকর্ম বলা যায়। কাজ করতে করতে আমি আমার টিভিটা কে ডারতিয় সমাচার চ্যানেলে দিয়ে রাখি। তখনই একটা মর্মান্তিক খবর আমাকে শিহরিত করলো। এমন খবর আজ থেকে বারো বছর পূর্বে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ঘটেছিলো। এই খবর তার থেকেও বেশি নৃশংস ও নোংরা। একটা যুবতী ডাক্তার যাকে কি না হাসপাতাল প্রশাসন ৩৬ ঘন্টার ডিউটি তে লাগিয়ে রেখেছিলো, সেই যুবতীর হাসপাতালের সুরক্ষিত প্রাঙ্গনে হয় অমানবিক গণধর্ষণ আর মর্মান্তিক হত্যা। ভদ্রলোকের কোলকাতায় তার ই একটা নাম করা হাসপাতাল ও মেডিকেল কোলেজে এই ঘটনা ঘটে আর তার পুষ্টি করে খবরের চ্যানেল।
|
Image has been taken from Google Women and Men protest against the horrific gangrape and murder in Kolkata, India |
খবর টা যেনো আমাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিলো। দুবাই তে আমি একা থাকি, আর ভারতে থাকে আমার স্ত্রী আর আমার কিশোরী মেয়ে। তাই বলা বাহুল্য যে এমন সব অপ্রত্যাশিত খবর আমাকে উদগ্রীব করার জন্য যথেষ্ট। একটা হাসপাতালের প্রাঙ্গনে যদি এমন ঘটনা, তাও আবার কোলকাতার মতন মহানগরে, ঘটে তখন অনেক প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এই সব ভেবেই আমার মনে অনেক গুলো বিচার আসে যেটা আমি এই গদ্যের মাধ্যমে অংকিত করছি। দেবীর শহরে আর মা শক্তি কালীর উঠনে একটা মেয়ের সাথে এমন নৃশংসতা যে হতে পারে এই কথা ভাবাটাও মুশকিল।
ভারতে যাঁরা থাকেন তাঁদের সব সময় এই চিন্তা লেগে থাকে যে তাঁদের ঘরের মহিলারা আদৌ নিরাপদ কি না। ভারতে মহিলা নিরাপত্তা একটা বিশেষ আর গুরুতর সমস্যা বললে ভুল বলা হবে না। প্রতি ষোলো মিনিটে যেখানে একটা মেয়ে ধর্ষিত হয়ে সেই দেশে মেয়েদের বাবার চিন্তিত হোওয়া কোনো তাজ্জবের কথা না। তার উপর যখন সেই বাবা একটা মধ্যবিত্ত বা গরীব ঘরের পালনকর্তা হয়ে সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা তার নিত্যকর্মে জড়িয়ে যায়। এই লোকেরা ভারতে এতোই দুর্বল যে তাঁদের পরিবারে যদি এমন দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে তাঁরা আইন প্রণালী কে হাতে করে শীঘ্র ন্যায় অর্জন করতে পারবেন না। তাঁরা হয়েতো ন্যায় প্রণালীর জাঁতাকলে আটকে নিজেরাও ইতিহাস হয়ে যাবেন। শেষ মতন এমন ঘটনা গুলো অন্যায়ের পরাকাষ্ঠায় পরিণত হয়ে আর কোনো কোনায় সরকারি ফাইলে ধামাচাপা পড়ে যায়।
গত অনেক বছর ধরে আমি সংযুক্ত আরব আমিরাতে আসি আর প্রায় দুই বছর ধরে এই জায়গায় বসবাস করি। একটা দৃশ্য আমাকে সব সময় অবাক করে সেইটা হলো এই দেশে মহিলাদের নিরাপত্তা। মহিলারা এই দেশে অত্যন্ত স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়। মহিলারা এই দেশে অনেক দেরি অবধি বাইরে ভ্রমণ করতে পারে তাও একা একা। এই দেশে মহিলাদের পরিধানের উপর কেউ অপ্রত্যাশিত কটাক্ষ করেন না, শ্লীলতাহানি তো দূরের কথা। মহিলাদের পরিধান যাই বা হোক না কেনো, সংস্কৃতিক ধারায় সেইটা হজম হোক বা না হোক, লোকেরা নিজেদের ব্যাক্তিগত মতামত ব্যাক্তিগত রাখে আর সামাজিক বা লৌকিক ভাবে তার অনাবরণ করেন না। সভ্য সমাজের এইটাই তো লক্ষণ।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে মহিলাদের উপর শ্লীলতাহানি করা একটা গম্ভীর অপরাধ, যার সাজা কঠোর আর তার উদ্যাপন খূব দ্রুত। ধর্ষণের শাস্তি এই দেশে মৃত্যুদণ্ড। ন্যায় প্রণালী এই সব ঘটনার দ্রুত তদন্ত এবং দ্রুত নিষ্কর্শণ করে। এর ভিত্তীতে সাজা ও বিচার খূব তাড়াতাড়ি সামনে এসে যায়। অবশ্য এত কড়া নিয়মের দৌলতে আমিরাতে এমন সব ঘটনা ঘটা একটা বিরল সংযোগ। লোকেদের, আর প্রধানরূপে যাঁরা অপরাধিক মানসিকতা রাখেন, তাঁদের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে যায়। তাঁরা এমন অপরাধ করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। Zero Tolerance for crime, এই সিদ্ধান্ত যে দেশ মেনে চলে, সেই দেশে নিরাপত্তা একটা কল্পনা না একটা জলজ্যান্ত সত্য। তাই ইতিমধ্যেই দেখা গেছে যে ভারত আর তার পাশ্ববর্তী দেশের থেকে অনেক লোকেরা স্বপরিবারে এই দেশে অভিপ্রায়ণ করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক গঠন, এখান কার জনহিতৈষী বাণিজ্যনিতি আর সব চাইতে বেশি এইখানকার সুরক্ষিত জীবন অনেক দেশের থেকেই লোকেদের আকর্ষিত করে। ভারতের থেকে ও যাঁরা তাঁদের কাজে দক্ষ তাঁরা এইখানে স্থানান্তরিত হোয়ার চেষ্টা করে। আর কেনোই বা করবে না। ভারত যেখানে তাঁর দক্ষ ও বুদ্ধিমান জনসংখ্যা কে করের জালে ফাঁসায় আর একটা দুধারু গরুর মতন ব্যাবহার করে সেই খানে আমিরাত তাঁদের দক্ষতা এবং তাঁদের পরিশ্রম কে সন্মান জানায়। তাঁদের সুরক্ষিত করে।
এই দেশে আপনারা নির্ভয়া, উন্নাউ, হাথরস, কাঠুয়া, আসিফা বা আর জী করের মতন নৃশংস ঘটনার ব্যাপারে শুনতে পারবেন না। হ্যাঁ যদি আপনারা এদের এমন সব অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার বিবরণ দেন তাহলে এরা অবাক হতে পারে। এই অবাক হোয়ার কারণ হোলো যে এরা এই ব্যাপার টা মেনে নিয়ে থাকে যে একটা সভ্য আর ভদ্র সমাজে এই সব ঘটনা ঘটে না। আমাদের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস এই ভদ্র সমাজের গঠনে পড়ে না এইটা আমাদের মেনে নিতে হবে। এরা অবাক তখন হোন যখন ভারতের ন্যায় প্রণালীর ব্যাপারে শোনেন। যে ন্যায় প্রণালী পীড়িতা কেই আসামি বানিয়ে রাখে তার ব্যাপারে কথা না বলাই ভালো। কচ্ছপের গতিতে চলা এই প্রণালী যে ধর্ষিতাদের জন্য আরেকটা ধর্ষণ, আর তার পরিবারের জন্য সামাজিক শ্লীলতাহানির চেয়ে কোনো অংশে কম না, এইটা বোঝা খুব একটা মুশকিল না।
|
Source X.com Survey Conducted by Georgetown University |
আমি মানছি যে হয়তো আমিরাত একটা আদর্শ দেশ নাও হতে পারে। গণতন্ত্র এই দেশে নেই। তবে এই দেশে যাই বা তন্ত্র থাক না কেনো, সেই তন্ত্র কাজ করে আর তার ভালো ফল এই দেশে যাঁরা বসবাস করে তাঁরা সবাই পায়। সে এই দেশের নাগরিক হোক বা আমার মতন অনেক প্রবাসী যাঁরা ভিন্ন ভিন্ন দেশের থেকে এই দেশে এসেছে। সবাই এই দেশের আইন ব্যাবস্থা দেখে হতবাক। আমার স্ত্রী আর মেয়ে যখন আমার সাথে এইখানে ছুটি কাটাতে আসে তখন আমি ওদের নিরাপত্তার জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করি না। আমার চিন্তা তখন হয়ে যখন ওরা অন্য কোনো দেশে বা ভারতে একা একা ভ্রমণ করতে বেরোয়। ভারত দেশের গড়ন যদিও গণতান্ত্রিক তবে সেই দেশে গণতন্ত্র যা গণরিয়া ও তা।
আমিরাতের নিয়ম সৃংখলা একটা উচ্চতম উদাহরণ যে কি ভাবে ভালো করে আইনের পালন এবং প্রবর্তনা করা হয়ে। কড়া সাজা, কড়া দন্ড এবং কড়া পালনের জন্য অপরাধিক মামলা অত্যন্ত কম। তেমন ই হোওয়া উচিত হয়তো। কখনো কখনো ভাবি যে গণতন্ত্র কি আদৌ কাজ করছে ভারতে, না জনতা শুধুই এই সাদা হাথী কে পোশার জন্য কালো করের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে! কালো কর, হ্যাঁ আমি তাই বলি। এই করের একটা টাকাও সাধারণ মানুষের উন্নয়ন বা সুরক্ষার কাজে লাগছে না। হচ্ছে শুধু বাতেলাবাজী আর রাজনিতীর নোংরা খেলা।
কখনো কখনো মনে হয় যদি ভারতেও এমন একটা সুস্থ তন্ত্র হোতো, যেমন কি আমিরাতে আছে, তাহলে কি ভালোটাই না হতো। কিন্তু আমি হয়তো একটা জিনিষ ভুলে যাচ্ছি। সেইটা হলো যে ভারতের নেতাদের জনতা তাঁদের স্বেচ্ছায় নির্বাচিত করে গদি তে বসিয়েছে। এইটা একটা কটু সত্য। আর সেই নেতারা যদি জনতার বিশ্বাসের সাথে ছিনিমিনি খেলে তাহলে দোষী সম্পুর্ণ জনতা, কোনো নেতা নন। এই তন্ত্র জনতা বেছে নিয়েছে আর তাই এর যত কুরিতী তার দাই ও জনতা। আজ যদি ভারতে মহিলারা নিরাপদ না হয় আর তাঁদের এই রাজনৈতিক খোক্ষোসেরা গ্রাসে গ্রাসে ভোগ করে তাঁদের বাসণাপূর্তির জন্য, তাহলে দাই শুধু আর শুধু জনতা। এই জনতা যাঁদের কাছে ক্ষমতা আছে কাউকে গদিতে বসানোর তাঁদের কাছে এই ক্ষমতাও আছে রাক্ষসদের গদি থেকে টেনে নামানোর, সে আইনত হোক বা না হোক। কারণ আইন জিনিষটাও তো জনতার সাহায্যে বানানো।
একবিংশ শতাব্দীতে নারীর যে এমন দুর্ভোগ হবে, তাও আবার এমন দেশে যেখানে নারীকে দেবীর স্থানে বসানো হয় তাহলে তো আর বলার ই কি থাকে। এক দিকে নারী রুপি দেবী কে পূজো করছে লক্ষী, সরস্বতী, দূর্গা আর কালী মেনে, অন্য দিকে সেই নারীর সন্মান কে বিচ্ছিন্ন করা তে এদের বিন্দুমাত্র লজ্জা করে না। যে সব দেশে এই গণতন্ত্র নামক সিদ্ধান্ত টা নেই কিন্তু একজন দূরদর্শী নেতা আছেন জিনি জনতা আর তাঁর দেশের উন্নয়ন আর সুরক্ষার জন্য কড়া নিয়ম বানান ও তার পালন অনিবার্য করান, সেই সব দেশে নারীর নিরাপত্তার কোনো তুলনা হয়ে না।
কথায় আছে
যত্র পূজ্যতে নারী।
রমন্তে তত্র দেবতা।।
অর্থাত যেখানে নারীদের সন্মান জানানো হয় সেইখানেই দেবতাদের বাস হয়ে।
হ্যাঁ খুব সম্ভবত দেবতারা বাসস্থান বদলেছেন।
জাম্বুদ্বীপ ছেড়ে দেবতারা পশ্চিম গামী হয়ে এই আরব প্রদেশে আস্তানা গেড়েছেন।