Tuesday, October 31, 2017

From the pages of the past (Part IX) [ Discipline ------ and the Uniform]

অনুশাসন ও ইউনিফর্ম 



আমাদের ছোটবেলায় "অধিকার" শব্দটার মানে অনেকেই বুঝতো না।  আমরা জানতাম  খেলা,মজা, পড়া, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদী।  কেননা আমরা আর আমাদের প্রজন্ম এই বাগদা বাগদা শব্দের দিকে উদ্ভাসিত ছিলাম না।  আমাদের সময় আমরা শিক্ষক কে শ্রদ্ধা করতাম আর কিছু অংশে ভয় ও পেতাম।  আমরা এই তথ্যটা ভালো ভাবে জানতাম কি যদি আমাদের বিরুদ্ধে শিক্ষক কোনো অভিযোগ করে তালে শিক্ষক আর আমাদের মাতাপিতা এক দলে থাকবেন।  

পর্ণশ্রীর কাছা-কাছী  আমার পাঠশালা ছিল।  যেটা বলতে পারেন একটা Pre-Primary School  যার নাম ছিল Sunny Preparatory School । আমি ওখানে তিন বছর কাটাই আর ওখানে তৈরী হয় আমার শৈশবের অনুশীলন।  অনুশাসন আমাদের জীবনে খুব দরকার।  আপসোস এটা আমরা বাল্যজীবনে বুঝতে পারি কিন্তু প্রাপ্ত বয়েসে আমাদের কেমন যেন একটা মানসিক দূষণ হয়ে যার ভিত্তি তে আমরা এই সব অনুশাসনিক পদ্ধতির জলাঞ্জলি দিয়ে দি বা একটা ঘুলঘুলি বের করে নি।  বড়ো হওয়াটা যে এই দেশে কত বড়ো অপরাধ তা আর কি বলবো।  তা থাকে এখন অনুশাসনে ফোকাস করা যাক।  

স্কুলে রেভা আন্টি আমাকে খুব পছন্দ করতেন।  অবশ্য আমার দুস্টুমি অগ্রাহ্য করতেন না।  তবে তিনি এমন এক জন টিচার যার কাছ থেকে আমি ওই স্কুলে স্ক্যালের বাড়ি খাই নি।  তাই আমার ভারী পছন্দ।  একদিন আমাকে কেউ বলেছিলো যে স্কুলে এই ইউনিফর্ম জাতীয় জিনিষটা একটা সাহেবি কায়দার নকল।  আমি অবশ্য তখন সাহেব, ফরাসি, জাপানি কিছুই বুঝতাম না কিন্তু বাবাদের আড্ডায় আড়ি পেতে এইটা শুনতে পেরেছি।  আর রীতিমতো এইটা বুঝতে পেরেছি কি বাবা আর তার বন্ধুরা খুব একটা উনিফর্মের সমর্থক না।  ব্যাস আমার ভেতরের বাঘা যতীন খেয়ে দিয়ে অনশনের জন্য প্রস্তুত। আমিও ভেবে নিলাম কি এই ইউনিফর্ম কে ত্যাজ্য করে নিত্য নতুন জামা পরে স্কুলে যাবো।  বিদ্রোহ হলো আমার মার সামনে আর পাখার (হাত-পাখার) বাড়িতে সে বিদ্রোহ ক্রন্দনের সুর করে দমন হলো।  তবে বিদ্রোহ-দমন রেখে গেলো একটা প্রশ্ন আর সেইটা হলো ইউনিফর্ম কত জরুরী ? 

সোমবার স্কুলে গেলাম আর নির্ধারিত করলাম কি রেবা আন্টির সাথে কথা বলবো।  কেননা আমার এই ক্রান্তিকারী বিচার শুনে স্কেল না মারার নির্ণয় খালি উনি নেবেন আর আমি পাখার বাড়ি আগেই খেয়ে নিয়েছি।  

রেবা আন্টি কে জিজ্ঞেস করলাম "আন্টি বোলো তো সবাই বলে কে ইউনিফর্ম হলো সাহেবি কায়দা তালে আর সাহেবি কায়দা খারাপ তাহলে আমরা ইউনিফর্ম কেন পরী?"

রেবা আন্টি হাসেন আর আমাকে বলেন " বাবা এতো বড় বড় কথা তুমি কি করে জানলে ?"

- " আমি আড়ি পেতে বাবা আর ওদের বন্ধুদের আড্ডা শুনেছিলাম "

- "তাই নাকি আর কি শুনেছ ? "

- " এই যে ইউনিফর্ম সাহেবি কায়দা, আগে নাকি ইউনিফর্ম ছিল না , আর কি সব পন্থী তন্থী ----"

- " বামপন্থী ?"

- " হ্যা হ্যা ওই    বামপন্থী"

- " ও আচ্ছা। তার পর।  "

- "অন্য দেশে নাকি এসব হয়ে না আমাদের দেশে এসব লাগানো এমন তেমন। "

-" শোনো কল্যাণ ইউনিফর্ম হলো একটা অনুশাসনের জিনিস "

- "অনুশাসন ? মানে "

- "আচ্ছা তালে এই ভাবে বলি।  আমাদের স্কুলে অনেক বাচ্চা পড়ে।  কারুর পরিবার ওদের পুজোর সময় খুব ভালো জামা কিনে দে আর কারুর পরিবার ওদের ওতো ভালো জামা কিনে দিতে পারে না।  এবার যদি ইউনিফর্ম না থাকে তালে কেউ খুব ভালো জামা পরে আসবে আর কেউ অটো ভালো জামা পরে আসবে না।  তার মানে সবাই সমান হবে না।  আর যারা ওই ভালো জামা পড়া বাচ্চাদের দেখবে তারা এই আবদার ওদের মা বাবা কে করবে।  আর মা বাবার সেই আবদার পুরো করতে পারবে না।  তাতে কি ভালো হবে ?"

- "না আন্টি তাতে তো খুব ভালো হবে না। ওরা কষ্ট পাবে। "

- "তাই তো।  সেই জন্য এই ইউনিফর্ম করা।  যাতে সবাই এক সমান দেখায়। UNI মানে হলো একরকম আর FORM মানে হলো দেখানো, সেই ক্ষেত্রে UNIFORM মানে সবাই কে এক মতন দেখানো।  আর সবাই যদি এক রকম দেখায় তালে সবাই কে এক রকম ভাবে দেখা হবে আর সবাই কে এক রকম ভালোবাসা বা মার দেওয়া হবে।  "

আমি বুঝতে পারলাম দুটো জিনিস।  

১. সমানভাবে ভালোবাসা আর মারের জন্য এই ইউনিফর্ম ই দায়ী।  

২. সাহেবরা সব কিছু খারাপ করে যায় নি।  

সেদিন থেকে আমার ইউনিফর্ম এর প্রতি টান আরও বেড়ে গেলো আর আমি খুব সংবেদনশীল হয়ে গেলাম এই ইউনিফর্ম নিয়ে।  

আজকে বুঝতে পারি রেবা আন্টি কত বড়ো কথা বলেছিলো।  আমরা আজকেও অনেক লোকেরা এই কথা বুঝতে পারে না।  আজকে এমন অনেক স্কুল আছে যারা ফ্যাশন ডিসাইনার দিয়ে ইউনিফর্ম বানায় আর গ্রাফিকাল ডিসাইনার দিয়ে বই ডিসাইন করে।  স্কুল , পাঠশালা, বিশ্ববিদ্যালয় আজ একটা বাণিজ্যিক রঙ্গভূমি আর এই রঙ্গভূমিতে স্নাতক আর অভিভাবকরা জোকার হয়ে ঘুরে বেড়াই।  আজকে রেবা আন্টির মতো শিক্ষকের অভাব তাই আমরা একটা ভীতু আর একটা non-informed প্রজন্মকে প্রশ্রয় দিচ্ছি।  

ইতি 

কল্যাণ 


Saturday, October 28, 2017

From the pages of the past (Part VIII) [Joda Ileesh - A pair of Silver Fish]

জোড়া ইলিশ 



আমরা যারা পূর্ব বঙ্গ  থেকে পশ্চিম বঙ্গে স্থানান্তরিত হয়েছি তাদের প্রিয় খাদ্য হলো বর্ষাকালের ইলিশ মাছ।  হ্যা ইলিশ মাছ হলো আমাদের এক রকম পরিচয় পত্র।  ইলিশ মাছ রান্না করতে বিশেষ কিছু কৌশল লাগে না।  একটু কালো জিরে আর কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে একটা পাতলা ঝোল ইলিশ মাছের করা যায় যেটা হলো কি এক রকমের প্রাথমিক ব্যঞ্জন।  

অবশ্য সেইটাই যে এক মাত্র ইলিয়াসের ব্যঞ্জন সেটা বলা ভুল হবে।  ইলিশ নিয়ে আসে নিজের সাথে অনেক অনেক ব্যঞ্জনের প্রকরণ আর সব গুলো বলা বোধহয় অসম্ভব।  তবে বর্ষা কালে মধ্যমগ্রামের বাড়িতে আমরা জোড়া ইলিশের স্বাদ নিতে বিলক্ষণ যেতাম।  

ঠাম্মা, মানে আমার ঠাকুমা, সব রকমের ইলিশ মাছের ব্যঞ্জন খুব সুস্বাদু বানাতো আর আমরা ছিলাম প্রধান ভক্ষক গণ।  

১৯৮৪, আর তখন আমাদের পরিবারে দুই রকমের লোকেদের আগমন হয়েছিল।  আমার বড়ো জেঠুর যমজ মেয়ে (রিয়া ওর রাকা) আর আমার ছোট ভাই (বুবু) । প্রসঙ্গটা আনন্দের আর উল্লাসের কেন না মুখার্জী পরিবার এখন আরো বিস্তারিত।  ঠাকুরদাদা জোড়া ইলিশ নিয়ে আসলেন।  

রবিবার দিন দুপুর বেলা আমাদের মধ্যমগ্রামের বাড়ির বারান্দায় কলাপাতা তে ইলিশের পাতুরি আর ইলিশের ঝোল দিয়ে ভাত করা হবে।  বিশেষ গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে ভাত তার উপর পদ্মা নদীর ইলিশের ব্যঞ্জন।  আমার ঠাকুরদা বাজার করতে উস্তাদ লোক ছিলেন তাই বেশ বড়ো বড়ো দুটো ইলিশ নিয়ে এসেছিলেন।  একটা ইলিশের ওজন আড়াই কিলোর মতো হবে।  ভক্ষক অনেক আর তাই এই ব্যবস্থা।  যাদের আগমন কে ঘিরেই এই প্রীতিভোজের আয়োজন তারা এখনো দুধের শিশু আর তারা জানেই না কি তাদের স্বাগতের জন্য কত লোকেরা আজ তৃপ্ত হবে।  

মধ্যমগ্রামের বাড়িতে একটা বিশাল বড়ো উনুন ছিল যেটা এই রকম ভোজের জন্য বানানো হয়েছিল।  তবে সেই দিন ওই উনুন ব্যবহার করা হয়নি।  আমরা যেহেতু গোটা ১০ এক ছিলাম তাই ছোট উনুনে রান্না হয়েছিল।  পাতুরি করা হলো কাঠ কয়লার আঁচে আর উনুনে হলো কালো জিরে দিয়ে ঝোল।  

কলাপাতার উপরে যখন এই পুরো খাদ্যটা ভোগ করা হলো তখন মনটা জুড়িয়ে গেলো।  

আজ ২০১৭, আমাদের সেই প্রীতিভোজ এখন ইতিহাস।  এমন এক ইতিহাস যেটা বোধহয় আমার মেয়ে বুঝতে পারবে না।  ও তো ইলিশ কে স্মার্ট ফোনেই দেখেছে।  আজ কাল বাচ্চারা তো আছে কিন্তু বালকিল্লতা নেই।  শিশু আছে শৈশব নেই।  আজ কাল আমরা চাই কি ছেলে মেয়েরা "Mature" হয়ে যাক।  শত হলে এই প্রতিশতের লড়াই যে লড়তে হবে।  কচিভাব থাকলে যে সে লড়াই ওরা হেরে যাবে।  তার পরে যদি ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারে ? যদি ওদের রেজাল্ট ভালো না হয়ে?  যদি ওরা ভালো কলেজে ঢুকতে না পারে ? সেই ভয় আমরা আমাদের অনেক এমন প্রীতিভোজকে ত্যাজ্য করেছি আর করবো।  

জানি না আমরা ভালো হওয়ার জন্য কষ্ট করছি না ভালো হয়ে কষ্ট পাচ্ছি।  

আজ এই পর্যন্ত।  

ইতি 

কল্যাণ 

From the pages of the past (Part VII) [Madhyamgram]

মধ্যমগ্রাম 







তখন আসির দশকের প্রাথমিক পর্যা হবে।  আমরা বেহালায় থাকতাম।  এক দিকে বরিশা তে আমার দিদিমা এবং দাদামশাই থাকতেন আর এক দিকে মধ্যমগ্রাম ছিল আমার ঠাকুমা আর ঠাকুরদার বাড়ি।  নিজেদের বাড়ি।  মধ্যমগ্রামের অনেক কথা আছে আর সেইটা এক অধ্যায় তে বলা অসম্ভব।  সবচে বেশি যেটা ভালো লাগতো সেটা হলো মধ্যমগ্রাম  যাওয়ার জন্য রেলগাড়ি তে  যেতে হতো।  


শিয়ালদাহ থেকে মধ্যমগ্রাম বোধহয় চার খানা স্টপ হবে আর মাজেরহাট থেকে শিয়ালদাহ আরও চার খানা স্টপ।  আমার জন্য ওই ট্রেন চেপে যাওয়া ছিল মস্ত বোরো মজা। 

আমার জন্ম মধ্যমগ্রামে।  আমার সব ভাই, বোন, বাবা, জেঠু এদের সবার মধ্যে আমার একার জন্মটাই কিন্তু ওই আমাদের নিজেদের বাড়িতে।  আমি জনমত স্বাধীন আর স্বস্ত্রীতো, আমি ভাড়া বাড়িতে জন্ম নিয় নি আর সেইটা বোধ হয় আমার জীবনের এক মাত্র অহংকার যেটা আমি এখনো পুষে রেখেছি।  

কলকাতা শহর থেকে দূর মধ্যমগ্রাম ছিল একটা দারুন জায়গা। ওই জায়গায় আমাদের বাড়ি আর আমাদের বাগার আরও ভালো। সব ভাই বোনেরা মিলে খুব মজা হতো।  তখন কার দিনে স্মার্ট ফোন না থাকলেও স্মার্ট মানুষেরা বসবাস করতো।  তাই মজা করে খেলতে আমাদের খুব একটা অসুবিধা আমাদের হয়ে নি।  আজ কাল অবশ্য ছোট বাচ্চাদের কুমির-ডাঙ্গা খেলার জন্যও স্মার্ট ফোনের দরকার পড়ে , আমাদের সময় তা ছিল না।  চারি দিকে গাছ , স্বচ্ছ জলের পুকুর ( আর হ্যা , স্বচ্ছতা ছিল কর মুক্ত ), সকাল বেলা শাস্ত্রীয় সংগীতের রেওয়াজ, উনুনের ধুয়া আর টাটকা ইলিশ মাছের ব্যঞ্জন।  সাধারণত মধ্যমগ্রাম যাওয়া হতো বর্ষা-কালে, লক্ষ্মী পুজোতে আর সরস্বতী পুজো তে।  প্রথম দুইটি প্রসঙ্গে ইলিশ মাছ আর তৃতীয় প্রসঙ্গে থাকতো পাবদা কিংবা পার্শে মাছের ব্যঞ্জন।  

খাওয়া তা হতো কলা - পাতার উপরে গরম ভাতের সাথে। এর সঙ্গে থাকতো আলু ভাঁজ, ডাল, গন্ধরাজ লেবু আর ভাতের উপর ঝর্ণা-ঘি।  বাঙালিদের কিন্তু ঘি পর্যন্ত আলাদা হয় এইটা আমি বাংলার বাইরে এসে বুঝতে পারলাম।  সন্ধ্যে বেলায় লোড-শেডিং হতো আর তখনি হতো বড়োদের গানের আসর আর আমাদের ছোটদের লুকোচুরি খেলা। ঘামতে ঘামতে, মশার কামড় খেতে খেতে  আমরা খেলা বন্ধ করতাম না।  পুরো খেলতাম।  আমরা জানতাম যে এই চার দিন আমাদের কেউ আটকাবার নেই আর আমরা পুরো ভাবে খেলতে পারবো। 

অনেক দিন আমি মধ্যমগ্রাম যায় নি।  প্রায় এগারো বছর আগে গেছিলাম আর সেও এক বেলার জন্য।  আসলে ঠাকুমা আর ঠাকুরদাদার অবসানের পর আর যাওয়া হয়ে না।  শুনেছি আমাদের ছোটবেলার সেই গ্রাম নাকি শহুরে নেশায় মেতে উঠেছে।  পুকুর ভরাট হয়েছে , অনেক ফ্লাট-বাড়ি তৈরী হয়েছে।  মেট্রো রেলের পরিকল্পনাও আছে।  অনেক রেস্টুরেন্ট হয়েছে আর সবার হাথে পৌঁছে গেছে স্মার্ট ফোন।  যেইটা আজ নেই সেইটা হলো ওই কলা-পাতায় খাওয়া আর সকালের ওই মন-মুগ্ধ করা আমেজ। 

মধ্যমগ্রামের ব্যাপারে আরও বলবো। 

ভালো থাকবেন 

কল্যাণ 

Friday, October 27, 2017

From the pages of the past (Part VI) [Nosh-Pukur]

নোশ পুকুর 





অনেক দিন পরে আবার লেখার মন হলো।  হ্যা জানি কি অনেক দিন হয়ে গেছে আমি নিজের অতীতের পাতা পাল্টাই নী।  কিন্তু যখন বর্তমান কাউকে ঘূর্নী ঘোরায় তখন অতীতকে স্মরণ করা খুব কঠিন। কিন্তু আজ অবসরে কিছু খুনের জন্য মনে করলাম। 

কালকে যখন আমি হাঁটতে যাই তখন নজর পড়ে একটা পুকুরের দিকে। এমন না কি পুকুরটা কখনো আগে দেখিনি কিন্তু কালকে ওই পুকুরটাতে দেখলাম দুটো ছেলেদের চান করতে সাঁতার কাটতে।  মনে হলো এমন যেন আমার সাথে আগে হয়েছে।  হয়েছে বৈকী। মনে পড়ে গেল নশ পুকুর।  হ্যা নস-পুকুর, আমার জীবনের হাসি আর কখনো কান্না।  

গরম কালের ছুটিতে আমরা আমাদের দাদুর বাড়ি যেতাম। দাদুর বাড়ি বরিষা।  বরিষা তখন প্রায় গ্রাম।  কলকাতার প্রদূষণ আর মনোমদ তখন বরিশাকে স্পর্শ করেনি। নারকেল গাছ, পুকুর, জমিদার বাড়ি, কাচা রাস্তা আর পুকুরপারে আড্ডা।  গরমকাল পরতেই কেমন জানি একটা মন হত কখন যাব দাদুর বাড়ি আর নশ পুকুরে সাঁতার কাটব। 

নশ পুকুর ছিল আমাদের আকর্ষণ, আমাদের গরমকালের পারিশ্রমিক।  নশপুকেরের ঠান্ডা জল গ্রীষ্মকালের গরমকে পুরো পুরী স্তব্ধ করে দিত।  আসে পাশে সুপুরী আরে নারকেল গাছ গ্রীষ্মকালের পশ্চিমী বায়ুতে দুলত আর পুকুরের জলে তরঙ্গ এনে দিত।  আমরা সেই জলে সাঁতার কাটতাম।  আমি আর আমার ছোট ভাই।  সেই দুপুর বার্তায় পুকুরে নেবে আমরা দুপুর দুটো অব্দি পুকুরের জলে পড়ে থাকতাম।  আমরা তখন বরদাতে থাকি। ঐখানে পুকুর ছিলনা তাই আমাদের এই পাগলামি নশপুকুর দেখে। 

নশ্পুকুর ছিল আমাদের বাড়ির গায়ে লেগে তাই খালি স্নানের সময় না অন্য সময় আমরা নশ্পুকুরের পাশে খেলতাম। কলকাতা ছেড়ে আমরা তখন গুজরাতে থাকি তাই ওই গরমকালের ছুটিতেই বরিষা তে এসে সব আল্ল্হাদ পুরো করতাম। ঝাল মুড়ি আলুর চপ পরশে মাছ আর নশ্পুকুর। 

নশ্পুকুর আমাদের অনেক সুখ দুখের সাক্ষী।  আমার মাসির বিয়ে, আমার দাদুর অবসান, আমাদের ঠাকুরের ভাসান।  সব নশ্পুকুর দেখেছে। আমাদের সাথে হেসেছে আর কেঁদেছে।  

২০১২ তে আমার দীদার অবসান হয়ে আর তার সাথে আমি নশ্পুকুরকে শেষ দেখি। আমাদের ফাঁকা বাড়ির মত সেও যেন কেমন মনমরা হয়ে আছে।  জল যেটা আগে আয়নার মত স্বচ্ছ ছিল যেটা আজ হয়ে গেছে ঘোলা।  আজ দায়িত্বহীন লোকেরা এই পুকুরে ময়লা ফেলে, জল নোংরা করে আর সেই তিরস্কার নশ্পুকুর চুপ চাপ সয়ে যায়ে আর কোনো বয়স্ক লোকের মত সবাইকে ক্ষমা করে দেয়ে।  যেই পুকুরে ঠাকুর ভাসান হয়ে সেই পুকুরেই আবার কেউ সিগারেট ফেলে আর কেউ চিপসের প্যাকেট।  আজ নশ্পুকুরে খুব কম লোকেরা স্নান করে।  আজ নশ্পুকুর অনাথ।  কিন্তু সেইটা কেন হয়েছে আমরা জানি। 
সুনেছি নাকি নশ্পুকুর ভরাট হয়ে যাবে। উন্নয়নের মাপদণ্ড। ভালই হলো।  যারা নশ্পুকুরের কদর করত তারা তো আর নেই।  নশ্পুকুর তাদের শ্রাধ্যের পিন্ডদান নিয়ে ভারী হয়ে গেছে। বোধ হয় তারাও নশ্পুকুরকে চাইছে তাই হয়েত।  

আজ আমি আমাদের এই পুরো প্রজন্মের তরফ থেকে আমার পূর্বপুরুষের কাছে ক্ষমা চাইছি কি আমরা ওদের এই ঐতিঝ্য়ের রক্ষা করতে পারিনি।  

From the pages of the past (Part V) [Foresignt of Mukherjee Jethu]

মুখার্জী জেঠুর গাড়ি  -  গেলো না দিঘা 




বনমালী নস্কর রোডের  যে বাসাতে আমরা ভাড়া থাকতাম তার ঠিক সামনে ছিল মুখের্জী জমিদার বাড়ি।  বিশাল বড় বাড়ি।  আসলে প্রাসাদ বললেই হয়ে।  বাড়িতে যে রান্নাঘরটা ছিল সেইটা আমাদের গোটা বাসাটার চে দ্বিগুন বড়।  ১৯৮৩ সনেও বনেদী মহিমা কিছু অংশে কম হয়ে নি।  তবে কি ইংরেজ রাজত্য তো আর নেই আর কম্পানি বাহাদুর ও ছিল না তাই জমিদারী কাজ কারবার আর ছিল না।  তবে মুখের্জী বাড়ির সামনে যে কারখানা বানানো ছিল সেইটিতে সম্পূর্ণ দখল মুখের্জী জেঠু, মানে ওই বনেদী বাড়ির বর্তমান অধিশ্বরের ছিল।  

মুখের্জী জেঠু কে কোনো অংশে একটা দুর্দন্তপ্রতাপ সামন্ততান্ত্রিক হিসেবে মনে হত না।  অত্যন্ত সরল লোক আর খুবই সাত্ত্বিক জীবন যাপন করতেন। পরনে ধুতি পাঞ্জাবী অধিকাংশ সময়ে আর সন্ধ্যে বেলা দালানে পায়চারী করে সসা খাওয়া অনার দিন্চর্য়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।  

এই সবের মধ্যে মুখের্জী জেঠুর বাড়িতে একটা দারুন জিনিস ছিল যেটা বোধয় ওই পাড়াতে কারুর কাছে ছিল না।  সেইটা ছিল মুখের্জী জেঠুর কালো রঙের ambassador গাড়িটা।  ১৯৮৩ তে আমি মাত্র ৩ বছরের শিশু, আর তখন ভারতের অর্থনিতী তেমন ছিল না যে সবার বাড়িতে গাড়ি থাকুক। গাড়ি আর দূরভাষ যন্ত্র সুধু শ্রীমন্ত লোকেদের আধীন ছিল আর এই দুইটি জিনিস মুখের্জী জেঠুর কাছে ছিল।  আমরা, মানে আমি আর আমার সমবয়েসী ও সম-অর্থী বন্ধুরা গাড়ি বলে taxi বুঝত আর বুঝত কলকাতার ঝুলন্ত বাস, আর কলকাতার ঐতিঝ্য কলকাতার ট্রাম।  

তবে যেখানে সমৃদ্ধি সেইখানেই কিন্তু ছিল কৃপনতা।  গাড়িটার দর্শন পাওয়া যেত সুধু রবিবার সকাল নটা নাগাদ যখন মাখন আর আরেকজন, যার নাম মনে পড়ছে না, গাড়িটাকে স্টার্ট দিত আর কিছুখুন বের করে আবার গ্যারেজ করে দিত।  পুরো কারবার চলত ১৫ মিনিট। যার মানে রবিবার ৯:১৫ থেকে পরের রবিবার ৯:০০ অবধি গাড়িটা গ্যারেজেই থাকত। 

আজকে আমরা সবাই প্রতি তিন বছরে নুতন গাড়ি কেনার চাহিদা রাখি।  আমরা যেখানেই যাই গাড়ি করে যেতে ভালোবাসি।  এইটা অগ্রাঝ্য করে কি কত তেল পুড়ে যাবে, বা রাস্তার অবস্থা না ভেবে। কিন্তু ওই ১৯৮৩ তে মুখের্জী জেঠু কিন্তু এই গাড়িকে নিয়ে যে সমস্যা হবে ৩০ বছর পর সেইটা দেখতে পেরেছিলেন। তখন তেল সংরক্ষণ কত প্রাথমিকতা পায়েনি বৈকি কিন্তু ভবিশ্বাতের অবস্থা কি হবে সেইটি জেনে কতে তেলের সংরক্ষণ যে হয়েছে তা কে জানে।  

আজ তাই আমি মুখের্জী জেঠু কে যারা কৃপণ বলত তাদের সবার হয়ে ক্ষমা চাইছি।  কেন না মুখের্জী জেঠু নিজের পরিমণ্ডলের উপর নিজের যা কর্তব্য সেইটি কিন্তু ৩০ বছর আগেই করে গেছেন। 


From the pages of the past (Part IV) [ The Reference Point]


সোনার টুকরো ছেলে 





আমরা জারা আজকের এই যুগে নিজেদের প্রগতি ও নিজেদের জীবনকে আরামদায়ক বানানোর জন্য নিজেদের এই প্রতিযোগিতামূলক জগতে ঝেঁকে দি তাঁরা এই টুকু যদি বুঝতে পারে কি প্রতিযোগিতা খালি রেসের ময়দানে ভালো আর জীবনে ভালো না তালে কিন্তু অনেক ভালো হয়ে। আমি এই বলছিনা কি নিজেকে বিস্তারিত ও আরও উন্নত করার জন্য মানুষের চেষ্ঠা করতে নেই । তবে নিজেকে উন্নত করা আর অপরের থেকে বেশি বড় হয়ে দাড়ানো দুটো ভিন্ন ব্যাপার । 

নিজেকে উন্নত করে হয়ে সন্তুষ্ঠী আর বেফিজূল স্পর্ধা করে ধকল বাড়ে। কিন্তু এই মিহিন পার্থক্যটা অনেকেই এড়িয়ে যায়ে । শৈশব থেকে শুরু হয়ে ঈদূর দৌড় আর এই দৌড় চলে জীবনের শেষ পর্যন্ত । আমি যে আমি আর আমি যে অপরের থেকে ভালো এই দুই বুলির মধ্যে দ্বিতীয় বুলিটাই বোধয় লোকেদের ভালো লাগে ।

দ্বিতীয় বুলি যদি সফল করতে হয়ে তালে দরকার পড়ে একটা উচ্চতার চিহ্ন, আর তাকে অনুসরণ করে তার থেকে ভালো হবার স্পর্ধা । কিন্তু কাউকে অনুসরণ করে কি ওর থেকে ভালো হয়ে ওঠা যায়ে? ব্যাপারটা ভাবার মতন । তবে শৈশবের কচি বয়েসে সেটা ভাবা জায়েনা আর লোকেরা ভাবতেও দেয় না ।

সৌরজ্যতী সব সময় ফার্স্ট হত । প্রথম শ্রেনীর ছাত্র । যাকে বলে বর্ণপরিচয়ের গোপাল । সব মায়েরাই চিত এমন একটা ছেলে বা মেয়ে । পাঠশালা যাওয়ার আগে সব মায়ের কাছেই অর ছেলে বিধান রায়, সুভাষ বোস বা রবীন্দ্রনাথ হয়ে কিন্তু পাঠশালার প্রতিযোগিতামূলক বাতাবরণ যখন তৈরী হয়ে তখন চোখের সামনের থেকে পর্দা সরে যায়ে আর বোঝা যায়ে কে কত জলে । 

আমাদের ও আমাদের সবার মায়েদের কেন্দ্র বিন্দু সৌরজ্যতী । Apple থেকে আরম্ভ করে zebra অবদি সব বানান মুখস্থ । অঙ্কে সব গণনা সঠিক । হাতের লেখা যেন মুক্ত । 

"নিশ্চয় ছেলেটা বড় হয়ে ডাক্তার হবে ।" মাদের নিত্য আলোচনার বস্তু সৌরজ্যতী। ওই কচি বয়েসে ও নিজেই জানত না কি ও কত বড় যশস্বী ব্যক্তি । 

আমরা সবাই ছিলাম প্রতিযোগী । সৌরজ্যতী আমাদের উচ্চতার মাপ দন্ড । তবে আমি  বুঝলাম সৌরজ্যতীর থেকে ভালো হতে গেলে সৌরজ্যতী কে অনুসরণ করা ব্যাপারটা কিন্ত খুব একটা ভালো প্রস্তাব না । তাই আমি আমার কির্তীযজ্ঞ কারবার খুঁজে বের করছিলাম । আমি সৌরজ্যতীর মতন নম্বর অর্জন করতে পারব না আর আমার নাম স্কুলের বোর্ডে লেখা হবে না । আমার খাতা টিচাররা অন্যদের দেখাবে না আর আমি ১০০/১০০ পাব না । আমার উত্তর্বহিনী লাল কালিতে সুসজ্য়ীত হবে সেটা অবধারিত । তাই চাপ নিয়ে লাভ নেই । 

সৌরজ্যতীর মত যদি কেন্দ্র বিন্দু হতে হয়ে তালে এমন একটা গুন খুঁজতে হবে যেটা খালি আমি পারি ।
মোড়ের মাথায় সুসভনের তেলেভাজার দোকান । আলুর চপ, বেগুনি খুব ভালো বানাত । আমার প্রিয় খাবার আর আমার কীর্তির প্রথম পায়্দান । 

ঘরে যাওয়ার সময় আমি আর আমার মা ছিলাম সাথে ছিল সৌরজ্যতী আর সৌরজ্যতীর মা । আমি হঠাথ বলে উঠলাম "মা আলুর চপ খাব"।  

মা কিছু বললনা আবার আপত্তিও করলো না । খালি বলল "বাড়ি গিয়ে ভাত খেতে হবে কিন্তু"। 
আমি বললাম " আচ্ছা খাব "।
"সৌরজ্যতী আলুর চপ খাবি, আমি কিন্তু খেতে পারি অনেক, তর থেকে বেসি ।" 
"হ্যা খাব, আর আমিও বেসি খেতে পারি ।"

মনে মনে ভাবলাম, খেলাটা ভুল চয়ন করা হয়েনী তো, এ যদি আলুর চপেও উত্তীর্ণ হয়ে ।

তবে সেইটে হলো না ৫ বনাম ২ ছিল স্কোর আর আমি বিজয়ী । মনের মধ্যে একটা অন্যরকম সন্তুস্থী হলো । ঠিক যেমন ফুটবল ম্যাচ জিতে হয়ে । 

তবে সেইদিন পেট খারাব গিয়ে আর বেদম পিটানি, কেননা যথারীতি ভাত খেতে পারিনি । 

সেদিন বুঝলাম, সব মানুষ অন্যরকম। অন্য কে হারাতে গিয়ে, নিজেকে হারিয়ে বসতে হয়ে, সেইটা বুঝলাম ।

কিন্তু সময়ের চাকিতে সেই চিন্তাধারা যেন আজ কোথায় পিসে গেছে কে জানে । আজ আমিও এই দৌড়ের  ভীড়ের ভেতর এক জন ।

From the pages of past (Part III) [My First Business Deal]

বুধবার সকাল বেলা। তখন বাজে ছটা।  সুধার মা , আমাদের কাজের লোক আর এক ঘন্টার মধ্যে এসে উপস্থিত হবেন। রাত্রীর বাসন এখনো পড়ে আছে আর সুধার মা না আসলে কাজ বেড়ে যাবে। কাজের লোকের আগমন যেন একটা আবির্ভাবের মহত্য একটা গৃহনির জন্য। জেঠু বলে কি সব পুজোর মধ্যে বিষ্ণু পুজো করে বিষ্ণু কে সন্তুষ্ট করা নাকি সবচে কঠিন, তেমনি একটা ভালো কাজের লোক পাওয়ার জন্য বিষ্ণু পুজো করা অনিবার্য, আমার মা বোধ হয় বিষ্ণু পুজো তে উত্তীর্ণ হয়েছিল তাই সুধার মার মত সময়নিষ্ঠ ও নিয়মনিষ্ঠ কাজের লোক পেয়েছিল। 

তবে সেই দিন বোধ হয় বিষ্ণু তাকুরের আলাদা মত ছিল। সুধার মা সেদিন আসলো না। তাড়া হুড়ো তে নখ কাটা হলো না । সন্নি স্কুল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় অর্ধেক কিলোমিটার দুরে ছিল । সাধারণত হেটে যেতাম, বাবা অফিস যাওয়ার পথে ছেড়ে দিত আর মা দুপুরবেলা নিয়ে আসত ।


নখ তো কাটা হলনা আর নখ না কেটে স্কুলে প্রবেশ করলাম। প্রার্থনা গাওয়া হলো, তারপর নখ পরীক্ষনের পালা । 

সব ছাত্রালয়ে বিদ্যাসাগরের গোপাল ও রাখল দুজনেই বসবাস করে। আমার খ্যাতি অবশ্য রাখালের মত ছিল । দুষ্টু বা দুরন্ত বললে ন্যূনোক্তি হবে বরঞ্চ আমাকে উগ্রপন্থীর শ্রেণীতে রাখা গেলে ভুল হবে না ।

"কল্যাণ আজকে নখ কেটে আসনি ?"

" না । মা আজকে নখ কাটতে পারেনি ।"

"কেন?"

"সুধার মা ডুব মেরেছে ।"

"সুধার মা? কে সুধার মা ?"

"আরে আমাদের কাজের লোক আন্টি , ও আজ ডুব মেরেছে ।"

"ডুব মেরেছে মানে, এটা কি কোনো ভাষা হলো? এমন ভাবে বলতে হয়ে? "

"আমি যা সুনেছি তাই বলেছি আন্টি "

You should always cut your nails. This is not the way to come to the school, I will have to call your father. Give me your hand. 

এমন সব সুনে  আমি আমার হাথটা আগে করে দী আর সটাং করে একটা স্কেলের বাড়ি খাই । কিছুক্ষণ ব্যথা করে বটে কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে ।

তবে এই কুকর্মে যে আমি একা নয় সেইটাও জানি । পলী মাসির মেয়ে শায়লা সেও আমার সাথে ওই সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল । শায়লা অবশ্য ওই স্কেলের বাড়ি ভালো ভাবে নিতে পারল না । দু চোখ দিয়ে গঙ্গা আর যমুনা বয়ে চলেছে । কি জানে কোন কারণে নিয়মিত ভাবে নখ কাটার প্রার্থী আজ নখ না কেটে এই আসামী পল্টনে দাঁড়িয়ে ছিল । 

"তুই নখ না কেটে এসেছিস "
" হ্যা "
" কেন পলি মাসি কেটে দেয়েনি "

শায়লার এই কথা সুনে কান্না আরও বেড়ে গেল । আসলে ব্যাপার ঠিক অন্য । ও কিন্তু পছন্দ করত না কি কেউ বলুক পলি মাসি অর নখ কেটেছে কেননা, শায়লা আমাদের মধ্যে একটা ছাপ বানিয়ে রেখেছিল কি অর নখ ও নিজে কাটে। আমি অবশ্য সত্যের সন্ধান পাই যখন অর বাড়িতে খেলতে যাই। শায়লা অর নখ কাটে না । পলি মাসি অত্যন্ত যত্নে ওর নখ কেটে দেয়ে। শায়লার এই গোপনীয় সত্য তখন খালি আমি জানি । তাই নিয়ে সেই কান্না । 

খুব ঝগড়া হত আমাদের, আবার আমরা সবাই মিলে খেলতাম খুব ভালো করে আমি, শায়লা, সৌরজ্যতি , ইন্দ্রনীল , স্বস্তিকা ও রণদীপ । ইংরেজি ক্লাস শেষ হবার পরেই খেলার সময় অবধি ছিল । তাই শায়লা কে বললাম 

"এই শায়লা "

"কি ?"

"আমি কিন্ত সব জানি"

"তার মানে"

"আমি কিন্তু সবাইকে বলে দেব কি তুই তর নখ নিজে কাটিস না, পলি মাসি কেটে দেয়"

"না। এমন করিস না। তুই নাকি আমার বন্ধু।"

" হ্যা সেটা ঠিক কিন্তু যদি তুই চাস কি আমি কাউকে না বলি তালে লুকোচুরি খেলায় আজ আমি দান দেব না । আমার দান তুই দিবি ।"

এই ছিল আমার প্রথম business deal । আজ যখন নিজেকে দেখি, নিজের পেশা কে দেখি , তখন বুঝতে পারি কি এমন কত কত business deal যে করেছি । কিন্তু ওই চুক্তি তে যে আরাম পেয়েছিলাম সেই আরাম আর সন্তুষ্টি বোধ হয়ে আর পায়েনি । ব্যবসায়ে যদি ছলাকলাশূন্যতা থাকত তালে কত ভালই না হত ।  যদি এই বিশ্বে সব নির্ণয় একটা বাচ্চার কচি মন নিতে পারত তালে কি এত গ্লানি, এত দুখ, এত ভ্রান্তি থাকত?  বোধ হয়ে না । 

হঠাত  চোখের সামনে দিয়ে যেন একটা আগুনের ঝলকানি হয়ে গেল । শায়লা কে ডাকার চেষ্টা করলাম ।  খানিকটা জোরে, কিন্তু আবাজ পৌঁছলো না । সেদিন ও যে দান দিয়েছিল সেটা বোধ হয়ে আজ দিচ্ছে , নত আমি হয়েত লুকিয়ে আছি এমন কোনো স্থানে যেখানে দান দেওয়ার পাত্রী শায়লা তো এক দিকে, নিজেই নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি না ।  

আমরা নিজেকে প্রগতিশীল বানিয়েছি, আলু কাবলি ছেড়ে হয়েত আলু-প্যাটি বার্গার খাচ্ছি, কিন্তু সন্তুষ্টি, শান্তি, আর খুশি কি পাচ্ছি? হয়েত সেটার উত্তর আমি নিজেও দিতে পারব না বা দিতে চাইনা । কেননা ইদুর দৌড়ে দৌড়তে  দৌড়তে আমি ল্যাজ বাঁচাতে ব্যস্ত । আমিও হয়ত মানুষরুপী ইদুর । 

বৈজ্ঞানিকরা বলে, স্বপ্ন শ্বেত-শ্যাম বর্ণ হয়ে , তবে স্মৃতি কিন্তু রঙ্গীন হয়ে। জানিনা শ্বেত-শ্যাম যুগের স্মৃতিগুলো আবার রঙ্গীন ভাবে দেখাতে পারব কি না । 

এর বর সোনাব সৌরজ্যতির কথা.... আমাদের "reference point"... যাকে বলে হীরের টুকরো ছেলের কথা...

From the pages of Past (Part - II)

সন্ধ্যা বেলা যখন শংখ বাজে তখন কেমন একটা অন্য রকম বাতাবরণ হয়ে ওঠে । মা বলে, কি ভগবান নাকি সন্ধ্যে বেলায় এক বার নজর দিয়ে দেখেন কি মর্ত লোকে বসবাস যারা করে তারা কি ঠিক মতন আছে না কারুর কোনো রকম কষ্ট হচ্ছে । তাই নাকি সন্ধ্যে বেলায় ঘুমোতে নেই । দেবতারা ভুল প্রতিক্রিয়া পান। শংখ বাজিয়ে ঘরের লোকেরা জানায় কি সব মঙ্গল আছে আর প্রার্থনা করে যেন সব মঙ্গল থাকে । আমার জন্য অবশ্য শংখ ছিল একটা বিপদ্সঙ্কেত, যেটা আমাকে বলত কি " এবার খেলা ছেড়ে বাড়ি যাওয়া উচিত নত পেদানী হতে পারে । 

আজ সহরের এই কোলাহলে খুব কম শংখ সোনা যায়ে। মার কথা যদি সত্তী হয়ে তালে এর দুটো তাত্পর্য হতে পারে ।

১. হয় তো সবাই এত সুরক্ষিত কি আজ কাল ভগবানকে কুশল সমাচার দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না ।

২. নত হয়েত ঈশ্বরের ভয় আর মনে নেই, তাই এই দৃষ্টতা ।

নত কি আওয়াজ এত কি শাঁখ সুনতে পাওয়া জায়েনা । 

যাক গে, অত যদি ভাবতে যাই তালে স্মৃতির পাতা উল্টোনো মুশকিল হয়ে যাবে । 

চুপি সারে ঘরে পৌছে যাই । আমরা যেই ভাড়া বাড়িতে থাকতাম তার সামনে মুখের্জী জেঠুর বিরাট জমিদার বাড়ি । বনেদী বাড়ির ঔজ্বল্য ও ঐশ্বর্য তখন পড়ে জায়েনী । তখন বেশ বড় বাড়ি , ঠাকুর দালান, চাকরের সেনা ও একটা মস্ত বড় রান্নাঘর, যেটা আমাদের গোটা ভাড়া বাড়ির থেকে দ্বিগুন বড় হবে । তবে মুখের্জী জেঠু কে দেখে কিন্তু মনে হত না কি উনি অত বড় জমিদার ও একটা lathe কারখানার মালিক । সন্ধ্যে বেলায় নিয়মিত মুখের্জী জেঠু বিশাল চত্বরে পায়চারী করে করে সসা খেতেন । জমিদারী মেজাজ প্রায় না বললেই হয়ে । অবশ্য এই জমিদারী মেজাজ না থাকার একটা বিশেষ কারণ আছে বটে । মাথায় প্রচন্ড চিন্তা । 

ভাস্কর , মুখের্জী জেঠুর গুণধর সন্তান, ও একমাত্র সম্পত্তি যার ওপরে ভারত সরকারের দাবি তখন অবদি হয়ে নী । অবশ্য সেইটা নিয়ে মুখের্জী জেঠু কোনরকম গর্ব দেখাতেন বলে তো মনে হত না । তবে ভাস্করদা আমার ছোট বয়েসের আদর্শ বলে ভুল হবেনে । মা, বাবা সবাই তখন নিজের ছেলেদের রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্র বসের উদাহরণ দিতেন, আমি চাক্ষুষ রবীন্দ্রনাথ দেখতাম সামনে । ভাস্করদা আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিশেষ কিছু পার্থক্য ছিল না । দুজনেই জমিদার বাড়ির গুণধর, দুজনেদের পেছনে ১৪ খানা মাস্টার , দুজনেদের পড়ায় কোনো মন ছিল না আর দুজনেরই রুচি ছিল কলায়ে । অবশ্য ভাস্করদার জন্য সেই কলাটা যদি সিঙ্গাপুরি হত তালে রুচি আরও বেশি নিত । 

" বাবু। ...... ও বাবু।.. সন্ধ্যে হয়ে গেছে, এবার হোম ওয়ার্ক শেষ করে নাও।  নাত আবার পিটানি হবে।  "

জানিনা কেন যে কাজের আগে মারের হুমকি হত।  আজকাল কার দিনের মাফিয়ারা কিন্তু আমাদের আগেকার দিনের মা বাবার মত হতে পারবে না । খালি দুটো প্রতিক্রিয়া । নয়তো আইসক্রীম খাওয়াবে নয়তো উধম কেলাবে । আমাদের পাড়ার একজন ভদ্রলোক বাড়িতে এসে রোজ এই হুমকি কে ইন্ধন যোগাতেন।  

" বৌদি তারকদার ছেলে, কি দুরন্ত ছিল, কি বলব।  তাকে আজে দেখে মনে হয়েনা ওই বাঁদরকে দেখছি।  "

" কেন কি হয়েছে নতেদা ?"

" সেই ছেলে এখন ডাক্তার।  "

" বলেন কি! কি ভাবে ? "

" তারকদার গুন আছে বলে ভুল হবে না।  ওই বাঁদর ছেলেটাকে প্রায় ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে ডাক্তার বানিয়ে দিলে ।"

" তাই নাকি।  রুমা বৌদির কি সৌভাগ্য।  সত্তী এক অবিশাস্য ঘটনা ।"

নতেদা, আমাদের পাড়ার চলন্ত সংবাদপত্র। কার বাড়িতে কত কাক এসেছে কত গমের দানা সরাতে পেরেছে তার খবর রাখতেন, অবস্য এই কাজ আজকাল আমাদের news channel গুলো করে, তবে তখন তো আর satellite TV ছিলনা, তাই নতেদা এই শূন্যতা পূর্ণ করত । 

আমি খালি সুনি "ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে ডাক্তার করে দেওয়া। "  হঠাত কেন যেন ডাক্তারি পেশা একটা খুব নিকৃষ্ট পেশা বলে মনে হলো।  মনে মনে ভাবলাম মার খেতে খেতে যদি ডাক্তার হয়ে তাই বোধ হয় নির্দয় হয়ে ছুঁচ ফোটাতে পারে। 

মোড়ের মাথায় ঘোষ ডাক্তার বসতেন, মনে হলো তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কত কেলানি খেয়েছেন।  

নতেদা নিজের চা শেষ করে চলে গেলেন, আবার কাল আসবেন বলে, আজ আমি ঢুকলাম পড়তে, বলেছিলাম না, কাল বুধবার, নখ পরীক্ষণ আছে ।

From the Pages of the Past (Part-1)

কালকে ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাথ যেন জীবনের কিছু পুরনো পাতা চোখের সামনে ভেসে উঠলো । হঠাত যেন অনেক কিছু জিনিস খুব তাড়াতারি মস্তিষ্ক ও চোখের মাঝে যে ফাঁক থাকে, সেই দিয়ে চলে গেল । অনেক জনের অনেক নামে আমায় ডাকলো, কেউ বাবু, কেউ বান্টী , কেউ আবার আমার ভালো নাম কল্যাণ । একে একে সবাই যেন ডাকছে । 

বইতে পড়েছি কি ইহলোক আর পরলোকের মাঝখানে একটা বিশাল বড় লোক আছে । সেই লোক পার না করে ওপার যাওয়া জাইনা । কারো কারো জন্য এই লোকটা বয় শুন্য রয়ের শুন্যর মত হতে পারে আর কোনো কনোর জন্য এইটা একটা অবিরাম মরুভূমির মত । জল নেই, আলো শুন্য, খালি বাতাস আর বালি । এই দুই তথ্যের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে এক মৃগ্ত্রিশ্নার । সেই মৃগ্ত্রিশ্নার ভেতরে থাকে স্মৃতী । কালকে বোধ হয় সেই মৃগ্ত্রিশ্নার দর্শন হয়েছিল ।

পর্ণস্রীর ওই পাড়া , তাপসদা, সন্জু, সন্নি স্কুল , শায়লা , স্বস্তিকা , বিগ আন্টী , রেবা আন্টী কেমন যেন দ্রুত বেগে চোখ আর মনের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে দেখা দিয়ে যায়ে । জানি না কারা বেঁচে আর কারা নেই । ভালো লাগলো । ইটের রাস্তা, পাসে  পুকুর, একটু লম্বা , খুব একটা দিঘীর মত কিন্তু অত বড় না । ওই ইটের রাস্তায় ক্রিকেট খেলতাম শীতকালে আর গরমকালে ফুটবল । মাঝে মাঝে যখন বল পুকুরে পড়ে যেত তখন এর অর ঘাড়ে দোষ চাপানো হত । 
 "এই বান্টি কেন এত জোরে কেন  মারলীরে, কোনো কান্ড গ্নান আছে কি সেটাও ডকে তুলেছিস ?"
  "না তাপসদা ব্যাস লেগে গেল ।" 
"লেগে গেল বৈকী, অত জোরে না মারলে বল কি হাওয়া ভেসে মাঝ পুকুরে চলে গেল ?"
"জানিনা তাপসদা। বোধ হয় এক্সপার্ট হয়ে গেছি। "
" ওহঃ এক্সপার্ট আমার।  তা সুনী বল কি এই এক্সপার্ট আনবে না কোনো জলপরী প্রকট হবেন বল দিতে। "
ভেতরে যেন কিছু খালি হয়ে গেল । এত বড় পুকুর, তাও আবার সাতার ঠিক জানা নেই , আবার বয়েসটা তো কম। তখনে মনে পড়ল বাবা কি বলেছিল।  
"ক্রিকেট খেলাতে ব্যাটসম্যান কিনা রাজা হয়ে, ছক্কা, চৌকো এবং ক্যাচ আউট সব অখ্যাতি ও সুখ্যাতি বোলার নেয়। "
নয়ন বোলিং করছিল তাই ঠিক সময় বাবার দেওয়া শিক্ষা কাজে এসে গেল।  একটা তুমুল বিবাদ আর আমি একা ওই বিবাদে আসামি ও রক্ষক। শেষ পর্যন্ত এই বিবাদ চলল আর খেলা মাথায় উঠলো।  সাড়ে পাঁচটার সময় সন্ধ্য শঙ্খধ্বনি হয়ে আর বল আনার চে বেশি ভয় করে সন্ধ্যের পরে ঘরে পৌছনোর । 
সাতটা বাজার আকে গৃহ কার্য শেষ করা অনিবার্য, নত সাড়ে সাতটায়, ঠিক সংবাদের পরে বিক্রম বেতাল দেখা যাবে না।  
অবশ্য গৃহ কার্য না করলে রেবা আন্টী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হবেন ও হয়েত স্কেলের বাড়ি খেতে হতে পারে । 

তখন কার দিনে স্কেল ছিল একটা আতঙ্কের বস্তু।  আজ অবশ্য আতঙ্কের পরিভাষা অনেক বদলেছে।  আজ আধুনিক হবার আড়ালে কথাও ওই আতঙ্কটা একটা ব্যঙ্গ হয়ে দাড়িয়েছে । কাল বুধবার, অর্থাত মধ্য সপ্তাহ আর সপ্তাহের সবচে ভয়া বহ দিন । কালকে নখ-পরীক্ষণ হবে, তার মানে সকালে নেল-কাটার চলবে আর সেই-খান থেকে ভয়ের সৃষ্টি ।

আজ যেন ওই বল মাঝ পুকুরে ভাসছে, প্রতীক্ষা করছে কোনো সাতারুর, ওই বল উঠিয়ে নিয়ে যাবে আর আবার খেলা শুরু হবে।  

হঠাত ঝড় তুমুল ঝড় , চারে দিকে বালী আর বালী, তাপশদাকে ডাকলাম কিন্তু নিজের আওয়াজ যেন নিজের কানেই গেল । তাপসদা উধাও, পুকুর আর নেই , কচুরি পানা, পাশে নারকোল গাছ কিছু নেই, সুধু মরুভূমি ।