মধ্যমগ্রাম
তখন আসির দশকের প্রাথমিক পর্যা হবে। আমরা বেহালায় থাকতাম। এক দিকে বরিশা তে আমার দিদিমা এবং দাদামশাই থাকতেন আর এক দিকে মধ্যমগ্রাম ছিল আমার ঠাকুমা আর ঠাকুরদার বাড়ি। নিজেদের বাড়ি। মধ্যমগ্রামের অনেক কথা আছে আর সেইটা এক অধ্যায় তে বলা অসম্ভব। সবচে বেশি যেটা ভালো লাগতো সেটা হলো মধ্যমগ্রাম যাওয়ার জন্য রেলগাড়ি তে যেতে হতো।
শিয়ালদাহ থেকে মধ্যমগ্রাম বোধহয় চার খানা স্টপ হবে আর মাজেরহাট থেকে শিয়ালদাহ আরও চার খানা স্টপ। আমার জন্য ওই ট্রেন চেপে যাওয়া ছিল মস্ত বোরো মজা।
আমার জন্ম মধ্যমগ্রামে। আমার সব ভাই, বোন, বাবা, জেঠু এদের সবার মধ্যে আমার একার জন্মটাই কিন্তু ওই আমাদের নিজেদের বাড়িতে। আমি জনমত স্বাধীন আর স্বস্ত্রীতো, আমি ভাড়া বাড়িতে জন্ম নিয় নি আর সেইটা বোধ হয় আমার জীবনের এক মাত্র অহংকার যেটা আমি এখনো পুষে রেখেছি।
কলকাতা শহর থেকে দূর মধ্যমগ্রাম ছিল একটা দারুন জায়গা। ওই জায়গায় আমাদের বাড়ি আর আমাদের বাগার আরও ভালো। সব ভাই বোনেরা মিলে খুব মজা হতো। তখন কার দিনে স্মার্ট ফোন না থাকলেও স্মার্ট মানুষেরা বসবাস করতো। তাই মজা করে খেলতে আমাদের খুব একটা অসুবিধা আমাদের হয়ে নি। আজ কাল অবশ্য ছোট বাচ্চাদের কুমির-ডাঙ্গা খেলার জন্যও স্মার্ট ফোনের দরকার পড়ে , আমাদের সময় তা ছিল না। চারি দিকে গাছ , স্বচ্ছ জলের পুকুর ( আর হ্যা , স্বচ্ছতা ছিল কর মুক্ত ), সকাল বেলা শাস্ত্রীয় সংগীতের রেওয়াজ, উনুনের ধুয়া আর টাটকা ইলিশ মাছের ব্যঞ্জন। সাধারণত মধ্যমগ্রাম যাওয়া হতো বর্ষা-কালে, লক্ষ্মী পুজোতে আর সরস্বতী পুজো তে। প্রথম দুইটি প্রসঙ্গে ইলিশ মাছ আর তৃতীয় প্রসঙ্গে থাকতো পাবদা কিংবা পার্শে মাছের ব্যঞ্জন।
খাওয়া তা হতো কলা - পাতার উপরে গরম ভাতের সাথে। এর সঙ্গে থাকতো আলু ভাঁজ, ডাল, গন্ধরাজ লেবু আর ভাতের উপর ঝর্ণা-ঘি। বাঙালিদের কিন্তু ঘি পর্যন্ত আলাদা হয় এইটা আমি বাংলার বাইরে এসে বুঝতে পারলাম। সন্ধ্যে বেলায় লোড-শেডিং হতো আর তখনি হতো বড়োদের গানের আসর আর আমাদের ছোটদের লুকোচুরি খেলা। ঘামতে ঘামতে, মশার কামড় খেতে খেতে আমরা খেলা বন্ধ করতাম না। পুরো খেলতাম। আমরা জানতাম যে এই চার দিন আমাদের কেউ আটকাবার নেই আর আমরা পুরো ভাবে খেলতে পারবো।
অনেক দিন আমি মধ্যমগ্রাম যায় নি। প্রায় এগারো বছর আগে গেছিলাম আর সেও এক বেলার জন্য। আসলে ঠাকুমা আর ঠাকুরদাদার অবসানের পর আর যাওয়া হয়ে না। শুনেছি আমাদের ছোটবেলার সেই গ্রাম নাকি শহুরে নেশায় মেতে উঠেছে। পুকুর ভরাট হয়েছে , অনেক ফ্লাট-বাড়ি তৈরী হয়েছে। মেট্রো রেলের পরিকল্পনাও আছে। অনেক রেস্টুরেন্ট হয়েছে আর সবার হাথে পৌঁছে গেছে স্মার্ট ফোন। যেইটা আজ নেই সেইটা হলো ওই কলা-পাতায় খাওয়া আর সকালের ওই মন-মুগ্ধ করা আমেজ।
মধ্যমগ্রামের ব্যাপারে আরও বলবো।
ভালো থাকবেন
কল্যাণ
No comments:
Post a Comment