মুখার্জী জেঠুর গাড়ি - গেলো না দিঘা
বনমালী নস্কর রোডের যে বাসাতে আমরা ভাড়া থাকতাম তার ঠিক সামনে ছিল মুখের্জী জমিদার বাড়ি। বিশাল বড় বাড়ি। আসলে প্রাসাদ বললেই হয়ে। বাড়িতে যে রান্নাঘরটা ছিল সেইটা আমাদের গোটা বাসাটার চে দ্বিগুন বড়। ১৯৮৩ সনেও বনেদী মহিমা কিছু অংশে কম হয়ে নি। তবে কি ইংরেজ রাজত্য তো আর নেই আর কম্পানি বাহাদুর ও ছিল না তাই জমিদারী কাজ কারবার আর ছিল না। তবে মুখের্জী বাড়ির সামনে যে কারখানা বানানো ছিল সেইটিতে সম্পূর্ণ দখল মুখের্জী জেঠু, মানে ওই বনেদী বাড়ির বর্তমান অধিশ্বরের ছিল।
মুখের্জী জেঠু কে কোনো অংশে একটা দুর্দন্তপ্রতাপ সামন্ততান্ত্রিক হিসেবে মনে হত না। অত্যন্ত সরল লোক আর খুবই সাত্ত্বিক জীবন যাপন করতেন। পরনে ধুতি পাঞ্জাবী অধিকাংশ সময়ে আর সন্ধ্যে বেলা দালানে পায়চারী করে সসা খাওয়া অনার দিন্চর্য়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
এই সবের মধ্যে মুখের্জী জেঠুর বাড়িতে একটা দারুন জিনিস ছিল যেটা বোধয় ওই পাড়াতে কারুর কাছে ছিল না। সেইটা ছিল মুখের্জী জেঠুর কালো রঙের ambassador গাড়িটা। ১৯৮৩ তে আমি মাত্র ৩ বছরের শিশু, আর তখন ভারতের অর্থনিতী তেমন ছিল না যে সবার বাড়িতে গাড়ি থাকুক। গাড়ি আর দূরভাষ যন্ত্র সুধু শ্রীমন্ত লোকেদের আধীন ছিল আর এই দুইটি জিনিস মুখের্জী জেঠুর কাছে ছিল। আমরা, মানে আমি আর আমার সমবয়েসী ও সম-অর্থী বন্ধুরা গাড়ি বলে taxi বুঝত আর বুঝত কলকাতার ঝুলন্ত বাস, আর কলকাতার ঐতিঝ্য কলকাতার ট্রাম।
তবে যেখানে সমৃদ্ধি সেইখানেই কিন্তু ছিল কৃপনতা। গাড়িটার দর্শন পাওয়া যেত সুধু রবিবার সকাল নটা নাগাদ যখন মাখন আর আরেকজন, যার নাম মনে পড়ছে না, গাড়িটাকে স্টার্ট দিত আর কিছুখুন বের করে আবার গ্যারেজ করে দিত। পুরো কারবার চলত ১৫ মিনিট। যার মানে রবিবার ৯:১৫ থেকে পরের রবিবার ৯:০০ অবধি গাড়িটা গ্যারেজেই থাকত।
আজকে আমরা সবাই প্রতি তিন বছরে নুতন গাড়ি কেনার চাহিদা রাখি। আমরা যেখানেই যাই গাড়ি করে যেতে ভালোবাসি। এইটা অগ্রাঝ্য করে কি কত তেল পুড়ে যাবে, বা রাস্তার অবস্থা না ভেবে। কিন্তু ওই ১৯৮৩ তে মুখের্জী জেঠু কিন্তু এই গাড়িকে নিয়ে যে সমস্যা হবে ৩০ বছর পর সেইটা দেখতে পেরেছিলেন। তখন তেল সংরক্ষণ কত প্রাথমিকতা পায়েনি বৈকি কিন্তু ভবিশ্বাতের অবস্থা কি হবে সেইটি জেনে কতে তেলের সংরক্ষণ যে হয়েছে তা কে জানে।
আজ তাই আমি মুখের্জী জেঠু কে যারা কৃপণ বলত তাদের সবার হয়ে ক্ষমা চাইছি। কেন না মুখের্জী জেঠু নিজের পরিমণ্ডলের উপর নিজের যা কর্তব্য সেইটি কিন্তু ৩০ বছর আগেই করে গেছেন।
No comments:
Post a Comment